জ্ঞান: মুমিনের পাথেয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি

ভূমিকা: জ্ঞান মুমিনের পাথেয়

মানুষ ছাড়া সব সৃষ্ট জীব জন্মগত জ্ঞান নিয়েই দুনিয়ায় আগমন করে অথবা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তারা সার্বক্ষণিক পথ চলে। এ জন্য জন্মের পর তাদের আলাদাভাবে কোনো স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় না। তাদের পথের দিশার জন্য কোনো নবী-রাসূলের আগমনও ঘটেনি বা তাদের জন্য কোনো আসমানি কিতাবও নাজিল হয়নি। আল্লাহর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে এরা তাঁরই দেয়া জ্ঞানে আকাশে ওড়ে, পানিতে সাঁতার কাটে, নিজেদের আবাস তৈরি করে এবং রিজিক সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। পৃথিবী নামক বিশাল এ কারখানাটি মহাশক্তিধর সুবিজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালার দেয়া কঠিন নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ। আল্লাহর বেঁধে দেয়া নিয়মের ভেতর থেকে প্রতিটি সৃষ্টি ক্রিয়াশীল। ফলে কোথাও বিশৃঙ্খলার লেশমাত্র নেই।

কিন্তু মানুষ এসব কিছুর ব্যতিক্রম। তাদের জ্ঞান আহরণের শক্তি দেয়া হয়েছে। ঈমান ও জীবনের জন্য তাদের জ্ঞানার্জনের সাধনা করতে হয়। এ জ্ঞানসাধনাই সৃষ্টিলোকে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। জ্ঞানই মানুষের চালিকাশক্তি। এ জন্য বলা হয় ‘জ্ঞানই শক্তি’। জ্ঞানের শক্তি বলে মানুষ গোটা পৃথিবীর শক্তিশালী সৃষ্টিকেও তাদের নিয়ন্ত্রণে এনে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে। জ্ঞানের আলো ছাড়া কোনো ব্যক্তি এক কদমও চলতে পারে না। জ্ঞানহীন ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। অন্ধকারে যেকোনো পথে চলতে চলতে বিপদের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হতে পারে। কারণ আলোর পথ হয় একটি ও সুনির্দিষ্ট আর অন্ধকারের পথ হয় অসংখ্য ও অনির্দিষ্ট।

জ্ঞান: মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল

মানুষের জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা তাকে অন্য সৃষ্টির থেকে আলাদা করেছে। এই জ্ঞান মানুষকে তার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে এবং তার চারপাশের জগতের নিয়ম বুঝতে সাহায্য করে। জ্ঞান হল সেই অস্ত্র যা মানুষের মধ্যে সৌন্দর্য, শিল্প, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সৃষ্টি করে। মানুষ যখন জানার চেষ্টা করে, তখন সে আল্লাহর সৃষ্টির গভীরতায় প্রবেশ করে এবং তার শক্তির সীমা দেখতে পায়।

জন্মগত জ্ঞান বনাম অর্জিত জ্ঞান

প্রাণিজগতে বাকি সব সৃষ্ট জীব জন্মগত জ্ঞান নিয়ে চলে, কিন্তু মানুষের জন্য জন্মগত জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। মানুষের আলাদা করে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন হয়। এই অর্জিত জ্ঞানই মানুষকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তার ক্ষমতা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে সে নতুন কিছু শিখতে পারে, তার জীবনকে উন্নত করতে পারে এবং তার পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

আল্লাহর নির্দেশনায় জ্ঞানের অনুসন্ধান

মুমিনের জন্য জ্ঞানার্জন একটি ইবাদত। কুরআন এবং হাদিসে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, "জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ।" আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, "পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আলাক, আয়াত ১)। এই নির্দেশনা অনুযায়ী মুমিনদের জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং সেই জ্ঞানকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যবহার করতে হবে।

ইসলামে জ্ঞানের গুরুত্ব

ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আল-খোয়ারিজমি, ইবনে সিনা, আল-ফারাবি প্রমুখ বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানীরা তাদের জ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছেন।

জ্ঞান অর্জনের পথ

মুমিনের জ্ঞানার্জনের পথ বিভিন্ন হতে পারে। আল-কুরআন, হাদিস, ইসলামী শাস্ত্র এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান- এই সবই জ্ঞানার্জনের মাধ্যম। মুমিনদের জন্য জ্ঞানার্জনের প্রথম এবং প্রধান উৎস হল কুরআন। আল্লাহর এই পবিত্র বাণী মানুষের জীবন চলার পথে সর্বোত্তম দিশারি।

কুরআন এবং হাদিস থেকে শিক্ষা

কুরআন এবং হাদিসের জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। কুরআনে রয়েছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য নির্দেশনা। হাদিসে রয়েছে নবী করীম (সা.)-এর জীবনের আদর্শ, যা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অনুসরণীয়।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানও মুমিনের জন্য জ্ঞানার্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, "তোমরা পৃথিবীতে বিচরণ করো এবং দেখো কিভাবে তিনি সৃষ্টির কাজ শুরু করেছেন।" (সূরা আনকাবুত, আয়াত ২০)। বিজ্ঞান মানুষের চোখের সামনে আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন করে এবং আল্লাহর শক্তির পরিচয় দেয়।

জ্ঞানার্জনের প্রভাব

জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মুমিন নিজের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। জ্ঞান মানুষের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষকে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত করে, তার চিন্তাশক্তিকে উন্নত করে এবং সমাজে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম করে।

নৈতিক উন্নতি

জ্ঞান মানুষকে নৈতিকভাবে উন্নত করে। ইসলামিক শিক্ষায় নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা একটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। কুরআন এবং হাদিসের জ্ঞান মানুষকে ন্যায়বিচার, সততা এবং দয়া শেখায়।

সমাজে নেতৃত্ব

জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মুমিন সমাজে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়। ইসলামে জ্ঞানীরা সর্বদা সম্মানিত। একজন মুমিন যখন জ্ঞানার্জন করে, তখন সে তার জ্ঞান দ্বারা সমাজকে উন্নত করতে পারে, সমাজের সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারে এবং সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।

উপসংহার: জ্ঞান মুমিনের সত্যিকারের পাথেয়

মুমিনের জন্য জ্ঞান হলো এক অতুলনীয় সম্পদ। এটি তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোর পথ দেখায়। ইসলামের প্রতিটি আদর্শিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার ভিত্তি হল জ্ঞান। তাই প্রতিটি মুমিনের উচিত তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন করা এবং সেই জ্ঞানকে আল্লাহর পথে ব্যবহার করা। জ্ঞানই মুমিনের পাথেয়, যা তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং তাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে।

জ্ঞান: মুমিনের পাথেয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি